লিয়াকত আলী,ঢাকাঃ গ্রামের অজপাড়াগাঁ থেকে জীবিকার খোঁজে আসা অনেকের স্বপ্ন থাকে রাজধানী ঢাকায় থাকবেন। সন্তানদের ভালো স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়িয়ে কাক্সিক্ষত ভবিষ্যৎ গড়বেন। কিন্তু জীবনযাত্রার অত্যধিক ব্যয়ে সেসব মানুষ বা পরিবারগুলোর তিলোত্তমা ঢাকায় থাকার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে।
কর্মহীন হয়ে পড়া, চাকরিতে বেতন কাক্সিক্ষত না বাড়াসহ আরও নানা সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে টিকতে না পেরে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেরই এখন এ শহরের মায়া ছাড়তে হচ্ছে। সরকারি হিসাবেই এক বছরে মানুষের ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। প্রকৃত হিসাবে নিম্নবিত্তের জীবন ধারণের ব্যয় সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলোকে সেই গ্রামেই ফিরে যেতে হচ্ছে।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রাজধানীতে থাকার স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাওয়া মিরাজ হোসেন নামে এক অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ১৫ বছর ধরে ঢাকায় সিএনজি অটোরিকশা চালান তিনি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন ঢাকার কদমতলীতে। গত ১৫ আগস্ট স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর পাঠিয়ে নিজে একটি মেসে উঠেছেন।
মিরাজ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, এক যুগে তিলেতিলে যা সঞ্চয় করেছিলেন, গত করোনায় সেই সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন। গত এক বছরে সংসারের ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। স্ত্রী-সন্তানের মুখে তিনবেলা ভাত তুলে দিতেই কষ্ট হচ্ছিল। গ্রামে থাকা মা-বাবাকে সংসার চালাতে টাকা পাঠাতে পারছিলেন না। তাই ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন। নিজে উঠেছেন একটি মেসে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের নিম্নবিত্ত, দিনমজুর-শ্রমিকসহ বেসরকারি পেশাজীবীদের ব্যয় বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। সেই হারে আয় বাড়েনি। সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে তারা ব্যয় সংকোচন করছেন। ফলে শ্রমিক শ্রেণির অনেক ক্ষেত্রে আয় আরও কমেছে। মানুষের সঞ্চয় কমছে। ব্যক্তির ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। গ্রামে গেলে অন্তত ঘর ভাড়াটা লাগবে না। এ ভরসায় তারা গ্রামের উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। রাজধানীর বুড়িগঙ্গা সেতুর পোস্তগোলা ব্রিজের ওপর দিয়ে গতকাল শুক্রবার সকাল ১০ থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টায় পাঁচটি পরিবারকে ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে মালপত্র নিয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে দেখা যায়।
ঢাকার রিকশা ও অটোরিকশা চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগের মতো এখন আর ভাড়া পাওয়া যায় না। আগে যে মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত রিকশা ও অটোরিকশায় চড়ত, এখন তারা টাকা বাঁচাতে বাসে যাতায়াত করছেন। আবার কেউ কেউ হেঁটেই যাচ্ছেন স্বল্প
দূরত্বের পথ। ফলে আয় কমে গেছে রিকশা ও অটোরিকশা চালকদের। খাবারসহ বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়েছে।
এ শহরে টিকে থাকার কঠিন লড়াই করছেন কারওয়ানবাজারের আবদুল জব্বার। তিনি এক যুগেরও বেশি সময় কারওয়ানবাজারে মিনতির (সবজির বোঝা বহনকারী) হিসেবে কাজ করেন। আগে সারাদিনে হাজার টাকার বেশি আয় হতো আবদুল জব্বারের। এখন কোনোমতে খেয়ে বেঁচে আছেন।
আবদুল জব্বার বলেন, আগে সবজির দাম ছিল কম। মানুষ ঝুড়ি ভরে বাজার করত। সেই বোঝা তারা মাথায় করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতেন। কয়েক মাসে সবজির দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে গেছে। আগে যারা ঝুড়ি ভরে বাজার করতেন এখন তারা ব্যাগে বাজার করছেন। সেই বাজার আবার নিজেই বয়ে নিচ্ছেন গন্তব্যে। ফলে মিনতিদের আয় কমে গেছে অনেক। এভাবে চলতে থাকলে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হবে। ইতোমধ্যে অনেক মিনতি কাজ ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানান আবদুল জব্বার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার ধাক্কা সামলে বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশেই কমবেশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হয়। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরপরই আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারকে আরও উসকে দেয়। বাংলাদেশকেও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাড়তি দামে পণ্য ও কাঁচামাল কিনতে হচ্ছে। এতে আমদানি খরচ বেড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচ আরও বেড়েছে। এ ছাড়া দেশের বাজারে জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানোয় উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। ফলে নিত্যপণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছেই।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যে পরিমাণ দাম বাড়ছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ দাম বেড়েছে দেশে। ফলে ভোক্তা চরম বিপদে পড়েছেন। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নবিত্তের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ার দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) জানায়, বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে তিন মাসে ৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। গত তিন মাসে উন্নয়নশীল বিশ্বে দারিদ্র্যের হার করোনা মহামারীর চেয়ে দ্রুত বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এ সংকটের আঁচ লেগেছে। এরই মধ্যে দেশে সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিগত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সরকারি হিসাবেই এখন মজুরি বৃদ্ধির হারের তুলনায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত বছরের জুনে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই পণ্য বা সেবা পেতে এখন ১০৭ টাকা ৫৬ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। অপরদিকে যে দিনমজুর-শ্রমিক বা অন্য পেশার মানুষ গত বছরের জুনে তার শ্রমের বিনিময়ে ১০০ টাকা পেয়েছেন, চলতি বছরের জুনে তারা পেয়েছেন ১০৬ টাকা ৪৭ পয়সা। অর্থাৎ বছর ঘুরে আয় বেড়েছে। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। উল্টো ১০৬ টাকা ৪৭ পয়সা আয়ের বিপরীতে এখন খরচ করতে হচ্ছে ১০৭ টাকা ৫৬ পয়সা।
রাজধানীর রামপুরা বৌবাজার বস্তির রোকেয়া বেগম বলেন, ‘মানুষের বাসায় কাজ করে মাসে ৪ হাজার টাকা পান। ঘর ভাড়া ১৮০০ টাকা। বাচ্চার পড়ার খরচ ১২০০ টাকা। আর এক হাজার টাকায় খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। বাজারে জিনিসপত্রের দাম, আমরা আর পারতাছি না। শাকপাতা খেয়ে জীবন চলতেছে।’ তিনি জানান, বস্তিটিতে ৪৩টা ঘরে ভাড়াটিয়া ছিল। তাদের মধ্যে কিছু দিনের ব্যবধানে ১৪ পরিবার গ্রামে চলে গেছে।
মানুষের ঢাকা ছাড়ার পেছনে নগরটি বাস অযোগ্য হয়ে পড়ার কিছু কারণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। যেমন- লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ১৭২ শহরের মধ্যে বাসযোগ্যতায় ঢাকার স্থান ১৬৬তম। পাঁচ সূচকের মধ্যে ঢাকা সবচেয়ে কম ২৬.৮ স্কোর পেয়েছে অবকাঠামোয়। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শিকার ঢাকার বাসিন্দারা। যানজটে প্রতিদিন সড়কেই কেটে যাচ্ছে নগরবাসীর ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা। অনেক এলাকার বাসিন্দাদের গ্যাস ও পানির কষ্ট জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে।