মনজু হোসেন,স্টাফ রিপোর্টারঃ পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ঘুষের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। ঘুষ ছাড়া কোনো দলিল পাস করেন না সাব-রেজিস্ট্রার মোঃ মিজানুর রহমান।
ইতিমধ্যে তার বেপরোয়া ঘুষ বানিজ্য পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে টক অব দ্যা টাউনে পরিনত হয়ে পড়েছে। যদিও সাব-রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমানের দাবী, একটি অসাধু মহল তার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রবাদ ছড়াচ্ছে।
এসময় খাস কামরায় অন্য কারো প্রবেশাধিকার বারণ থাকে। খাস কামরার ভিতরের অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের চিত্র বাইরে থেকে দেখা না যাওয়ার জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তিনি তার কক্ষের কাঁচের সাদা জানালাগুলো কালো রং করে দিয়েছেন।
জমি ক্রেতা-বিক্রেতা ও দলিল লেখকরা বলছেন, সাব-রেজিস্ট্রার মো. মিজানুর রহমান ঘুষ ছাড়া কোনো দলিলই পাস করেন না। এজন্য তিনি এজলাসে না বসে তার খাস কামরায় বসেই দরজার সামনে পিয়ন কমিরুলকে রেখে অধিকাংশ দলিল পাস করেন।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে জানান, সাব-রেজিষ্টারে মনোনীত অফিস পিয়ন কমিরুল ইসলামের ঈশারা পেলে তবেই তিনি দলিলে স্বাক্ষর করেন।
তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন দুই/তিনজন দলিল লেখকসহ কর্মচারী কমিরুল ইসলাম।
এব্যাপারে সাব-রেজিস্ট্রার মোঃ মিজানুর রহমানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আপনারা যা শুনেছেন তা সঠিক নয়। একটি অসাধু মহল আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রবাদা ছড়াচ্ছে।
অন্যদিকে ঘুষ নেয়ার বিষয়ে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মচারী কমিরুল ইসলাম বলেন এ বিষয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলেন কমপক্ষে ২/৩ হাজার টাকা দিবে। স্যার কাউকে খালি হাতে ফেরত দেন না।
অভিযোগ উঠেছে সাব-রেজিষ্ট্রার মো.মিজানুর রহমানের যোগদানের পর হতে তার স্বেচ্ছাচারি আচরণ আর ঘুষ বানিজ্যে ক্রেতা-বিক্রেতাসহ দলিল লেখকগন পদে পদে হয়রানির শিকার হয়ে আসছেন।
এনিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে সম্প্রতি উপজেলার দলিল লেখকগণ সাব-রেজিষ্ট্রারের বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসুচি পালন করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।
পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের হস্তক্ষেপে দলিল লেখকগন সাব-রেজিষ্ট্রী অফিসে ফিরে যান। সাব-রেজিষ্ট্রী অফিসের লাগামহীন ঘুষ বানিজ্যের তথ্য অনুসন্ধানে জানাযায়, অতি সম্প্রতি আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ব্যবসায়ীর ব্যাংক মর্টগেজ দলিল পাস করতে সরকারী ফি ব্যতিত ৪ হাজার টাকা এবং আটোয়ারী আদর্শ মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নানের হেবা দলিল বাবদ ৩০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন।
তিনি নানান অজুহাত সৃষ্টি করে সরকারি ফি ব্যতিত খোস কবলা দলিল প্রতি দেড় হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা, হেবা ঘোষনাপত্রে জন্য ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা, বিক্রেতার দলিলের অক্ষর অস্পষ্ট কিংবা ঘসামাজা থাকলে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, ব্যাংক মর্টগেজ দলিল প্রতি ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, দানপত্র দলিলে প্রতি শতক ৩ শত টাকা, ওসিয়ত দলিলে শতক ৫০ টাকা, বন্টকনামা দলিলে শতক ২০ টাকা সহ বিভিন্ন দলিলের জন্য সরকারি ফি ব্যতিত অলিখিত অতিরিক্ত ফি’ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
ইউপি সদস্য তৌহিদুল ইসলাম জানান, আমার কাগজপত্র সবকিছু ঠিক থাকার পরও সরকারি ফি ব্যতিত ১২ হাজার টাকা অতিরিক্ত চাওয়ায় আমি জমি রেজিষ্ট্রী না করে ফেরৎ এসেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দলিল লেখক জানান, ঘুষের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দন্দের জেড়ে সম্প্রতি দলিল লেখক সমিতির সভাপতি গোলাম উদ্দিনকে সাব-রেজিস্ট্রার তার খাস কামরায় আটকে রাখেন।
পরে টাকা পরিশোধ করে তাকে মুক্ত করেন অন্যান্য দলিল লেখকগন। এঅবস্থায় তিনি সহ কয়েকজন দলিল লেখক এখন সাব-রেজিষ্ট্রারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছেন এখানে।
এদিকে দলিল লেখক ইউসুফ আলী বলেন, কর্তা যেভাবে চালান আমরা সেভাবেই চলি। এর চেয়ে বেশি বলার দরকার নেই। দলিল করতে আসলে স্যার কোন না কোন ভুলক্রুটি বের করবেনই। এটা সবাই বোঝে। বর্তমানে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের ইট বালিও টাকা ছাড়া কথা শোনবেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক দলিল লেখক বলেন, স্যারের প্রতিদিনের ইনকামের ছিটে-ফোঁটা কয়েকজন দলিল লেখকের পকেটে যায়।
আটোয়ারী উপজেলার জনৈক সংবাদকর্মী গ্রাহক সেজে কাগজ-পত্রে কিছু সমস্যা কথা তুলে ধরে দলিল লেখক গোলাম উদ্দীনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, টাকা দিলে সব হবে। সীল সই সহ আমরাই ওয়ারিশানপত্র বানিয়ে দিতে পারি। তবে, খরচ পরবে প্রায় ৬/৭ হাজার টাকা। স্যার (সাব-রেজিস্ট্রার) কেই দিতে হবে । টাকা দিলে এক দিনেই কাজ করে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
এছাড়াও পরিচয় গোপন রেখে জমি রেজিষ্ট্রীর বিভিন্ন জটিলতার সমাধান চাইলে এর উপায় ও কলাকৌশল বলে দেন দলিল লেখক মোঃ জহিরুল ইসলাম। তিনি জানান, দলিল ঘষামাজার জন্য স্যারকে দিতে হবে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। আর আমাদের চা খরচসহ মোট ৫ হাজারের মতো পরবে।
এদিকে অতি সম্প্রতি সাব-রেজিস্ট্রারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে দুইটি বেসরকারী টেলিভিশনের পঞ্চগড়ের জেলা প্রতিনিধিকে আটকে রেখে হেনস্থা করেন তিনি। পরে খবর পেয়ে আটোয়ারী থানা পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। এব্যাপারে পঞ্চগড় বিজ্ঞ আদালতে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।