নুসরাত জাহান মেরি, বেরোবি প্রতিনিধি: কাকলি শাহরিন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। চার বছরের স্নাতক শেষ হওয়ার কথা ২০১৭ সালে।
কিন্তু সাত বছরের স্নাতক শেষ করতে পারেননি। এখন স্নাতক চতুর্থ বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ছেন। যেখানে তার সহপাঠী অনেকেই স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি খুঁজছে, সেখানে তিনি এখনো স্নাতকের গন্ডি পার হতে পারেননি। সেশনজটে নাস্তানাবুদ বেরোবির এই বিভাগ। এরমধ্যে নতুন করে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে করোনা মহামারি।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা থামিয়ে দিয়েছে স্বাভাবিক জনজীবন। সবাইকে করে দিয়েছে একেবারে ঘরবন্দি। দীর্ঘ দিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় অনলাইনে ক্লাস চললেও আশানুরূপ ফলাফল নেই। তাত্ত্বিক জ্ঞান কিছুটা মিটলেও ব্যবহারিক ক্লাস থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। শুধু জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ বিভাগ নয়, এমন পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ বিভাগের।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় উত্তর জনপদের সর্বোচ্চ পূর্ণাঙ্গ একটি বিদ্যাপীঠ। ৭৫ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা ক্যাম্পাস এখন সুনশান নিরবতা আর নিস্তব্ধতায় বিদীর্ণ। একসময় হাজারো শিক্ষার্থীর পদচারণ ও কোলাহলে মুখরিত ক্যাম্পাস এখন নিস্তব্ধ। আগের মতো শিক্ষার্থীদের আনাগোনা নেই, নেই আড্ডাবাজি ও দুরন্তপনা। ব্যস্ত ক্যাম্পাস যেনো একেবারে কোলাহল শূন্য। করোনা মহামারিতে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ সময় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সেশনজটসহ নানামুখী শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাজারো শিক্ষার্থী। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও সেসব শিক্ষার্থীর ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে কিংবা অধিকাংশ পরীক্ষা শেষ হয়েছে তাদের বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি। এছাড়া প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাব, ডিজিটাল ডিভাইস জটিলতা, নেটওয়ার্ক স্বল্পতায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কম হওয়ায় অনলাইন ক্লাস কার্যক্রমও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
এমন অবস্থায় শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীদের। দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় সেশনজট বাড়িয়ে দিয়েছে নতুন করে শঙ্কা। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রধান সমস্যা দেখা দেয় সেশনজট। সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার আগেই নতুন করে জটিলতা তৈরি করে মহামারি করোনা ভাইরাস। করোনা সংক্রামক রোধে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন ক্লাসেই ভরসা তাদের। কিন্তু অনলাইন ক্লাসেও রয়েছে জটিলতা, গ্রামীণ জনপদে নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারেন না। এছাড়া সবার কাছে নেই স্মার্ট প্রযুক্তির মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপ। আর যাদের স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা তারাও এখন সেশনজটে আটকা। তবে, সব জটিলতা ভেদ করে দ্রুত ক্লাসে ফিরতে চায় শিক্ষার্থীরা। সেশনজট ভেঙে পড়াশোনার গন্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে ফেরার প্রত্যাশা তাদের। এছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের এবং সেশনজটের কারণে চাকরির বয়সসীমা দ্রুত পার হয়ে যাওয়াই তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশার।
বিশ্ববিদ্যালয় সুত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি মোট ২১টি বিভাগ চালু রয়েছে। এরমধ্যে ১১টি বিভাগেই সেশনজটের কবলে। জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ এখনও স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টারেই রয়েছে। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা রয়েছে চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারে, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারে,২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা রয়েছে দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারে এবং সর্বশেষ ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা এখনও রয়েছে প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারেই। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষা হলেও ফল প্রকাশ হয়নি এখনও। বর্তমানে বিভাগটিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ছয়টি ব্যাচ রয়েছে। সেশনজটের প্রায় একই অবস্থা লোকপ্রশাসন ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগেও। বিভাগ দুটিতে বর্তমানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে ছয়টি ব্যাচ রয়েছে।২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে এখনও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে পারেনি পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন এবং গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী। ফলে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর মিলে পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করতে তাদের সময় লাগছে প্রায় আট বছর। উচ্চশিক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে তারা ভর্তি হয়েছিলেন, সেশনজটের কারণে সে স্বপ্ন আজ ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে। বাকি ১০টি বিভাগ কিছুটা সেশনজট মুক্ত। এগুলো হলো- ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই), ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। এরমধ্যে করোনা মহামারির কারণে নতুন করে সেশনজট দেখা দিয়েছে সবগুলো বিভাগেই। পূর্বের সেশনজটে থাকা বিভাগ গুলোর ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন দেয়া হলেও সেগুলো বন্ধ রয়েছে। ফলে নতুন করে স্নাতক শেষ করা নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষার্থীরা। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দুরত্ব মেনে ক্লাস ও পরীক্ষায় ফিরতে চায় শিক্ষার্থীরা।