প্রতিদিনের বাংলাদেশঃ ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমন, বিদ্যুৎ ঘাটতি আর জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্যের প্রভাব পড়ছে পাঠ্যবই মুদ্রণে। বিভিন্ন কাঁচামালের বাজার ইতোমধ্যে বেসামাল হয়ে পড়েছে।
২ মাস আগে কাগজ-কালিসহ অন্যান্য পণ্যের যে দর ছিল, তা ইতোমধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। পরিবহণ ব্যয় ও শ্রমিক মজুরি বেড়েছে দেড় থেকে দ্বিগুণ।
অন্যদিকে কাজ পাওয়ার জন্য নজিরবিহীন প্রতিযোগিতায় নেমে এবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অবিশ্বাস্য হারে কম দর হাঁকে। এটা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ক্ষেত্রবিশেষে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কম।
একদিকে ঊর্ধ্বমুখী বাজার, অন্যদিকে নিম্নদরের কারণে পাঠ্যবই মুদ্রণ নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
এ অবস্থায় আগামী বছর যথাসময়ে বিতরণ দূরের কথা, পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ দেওয়া যাবে কি না, সেই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘দর সমন্বয় না করলে এবার যে যথাসময়ে পাঠ্যবই ছাপানো যাবে না এবং নিউজপ্রিন্টে মুদ্রিত হবে-এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
মুদ্রাকররা যে সময়ে প্রতিযোগিতা করে কম দরে দরপত্র দাখিল করেছেন, এখন কাঁচামালের সেই বাজারদর থাকলে হয়তো কম লাভেও তারা কাজ তুলতে পারতেন।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষতি থেকে বাঁচতে ইতোমধ্যে অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান কাজ করবে না বলে চিঠি দিয়েছে। তাই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এখনও যদি দর পুনর্বিবেচনা না করে, তাহলে এই তালিকা আরও দীর্ঘ হবে।’
সরকার ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার প্রায় ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার বই ছাপার উদ্যোগ নিয়েছে। সাধারণত বই মুদ্রণে যাওয়ার আগে বাজার দর দেখে এনসিটিবি প্রথমে প্রাক্কলন (সম্ভাব্য দর) ঠিক করে থাকে।
এবার প্রাথমিকের বই প্রতি ফর্মা (১৬ পৃষ্ঠা) ২ টাকা ৯০ পয়সা ঠিক করা হয়। কিন্তু মুদ্রাকররা সর্বনিম্ন ১ টাকা ৯০ পয়সা পর্যন্ত দর হেঁকেছেন, যা প্রাক্কলনের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কম।
যদিও যারা ২৫ শতাংশ কম দর দিয়েছেন, তাদেরকে কাজ দেওয়ার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে এনসিটিবি ফাইল অনুমোদনের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
অন্যদিকে মাধ্যমিকের যে বই ৭০ জিএসএমে রঙিন ছাপানো হয়, সেগুলোর প্রাক্কলিত দর ২ টাকা ৬৮ পয়সা, আর যে বই ৬০ জিএসএমের তার প্রাক্কলন ১ টাকা ৯৩ পয়সা ফর্মা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
কিন্তু মুদ্রাকররা উভয় ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ কমে দরপত্র দাখিল করেন। এরইমধ্যে বাজার দর চড়া হওয়ায় অন্তত ৫টি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক স্তরের কাজ নেয়নি।
আর নয়নমণি প্রিন্টার্স, মুছা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, তায়েবা প্রিন্টার্স, বর্ণমালা প্রেস ও দোহার প্রিন্টিং প্রেসসহ অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিকের কাজ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫ জুলাই খোলাবাজারে ডলারের দাম ছিল ৯৪ টাকা, যা ১১৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের জ্বালানির দাম ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
ওইসময়ে কাগজের মিল-দর ছিল ৯৫ হাজার টাকা, যা এখন ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। সবমিলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তাই যৌক্তিক মূল্যায়ন না হলে শেষ পর্যন্ত অনেকেই কাজ করবেন না বলে জানান তারা।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলামের অভিযোগ, এনসিটিবি চেয়ারম্যানসহ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব বাস্তবতা বুঝলেও (এনসিটিবির) সংশ্লিষ্ট সদস্য বাগড়া দিয়েছেন।
তিনি সর্বনিম্ন দরে কাজ দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এমনটি হলে হয়তো কাজ করার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অনেকটা একমত পোষণ করে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম রোববার বলেন, ‘বাজার দরের চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে মুদ্রাকররা সরকারি প্রাক্কলনিত দরের চেয়েও কম দাম দিয়েছেন। তাই এখন সংকট তৈরি হয়েছে। যদিও এর থেকে বের হওয়ার উপায় তাদের দেওয়া দর পুনর্বিবেচনা। কিন্তু সেটা না চেয়ারম্যান এমনকি সরকারি ক্রয় কমিটিও পারবে না, যদি না দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বাস্তবতা আমলে নেয়। এখন করণীয় নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চাওয়া হবে।’