আসাদুল ইসলাম সবুজ ॥ ৪ সন্তানের জননী মোছাঃ শিল্পী বেগম (৩৫), তার স্বামী খোরশেদ আলম, পেশায় কুড়িগ্রাম শহরে ফেরিওয়ালা। বাড়ি লালমনিরহাট পৌরসভাধীন ১নং ওয়ার্ডের বানভাষা মোড় এলাকায়। হতদরিদ্র পরিবারের স্বামীর আয়ের টাকা ৬ সদস্যর সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। তাই শিল্পী বেগম এলাকাবাসীর নিকট থেকে গাভীর দুধ সংগ্রহ করতেন। সেই গাভীর দুধ একই ওয়ার্ডের বত্রিশহাজারী এলাকার আনোয়ারুল বিদেশীর বাড়িসহ বেশকিছু বাড়িতে নিয়মিত দুধ দিতেন। মাস শেষে দুধের টাকা উত্তোলন করতেন। এতে কিছু আয় হত, যা সংসারের কাজে লাগত।
আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওই বিদেশীর একটি নিকটতম আতœীয় লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের সাতপাটকী এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারে একটি মেয়ে সন্তানের দরকার ছিল। কিন্তু ৪ সন্তানের জননী মোছাঃ শিল্পী বেগমের কাছে ৪র্থ সন্তানের গর্ভবস্থা থাকাকালীন সময় থেকে তার কাছে সন্তান দত্তক চাই ওই বিদেশী পরিবার। এতে রাজি হয়নি ৪ সন্তানের জননী। তখন বিদেশী পরিবারটি শিল্পীকে সন্তান বিক্রি করতে টাকার প্রলোভন দেখান।
এরমাঝে শিল্পী বেগমের ৪র্থ সন্তান প্রসবের বেদনায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ত্রীর অসুস্থতার খবর স্বামীকে না দিয়ে গত ০৯/০৯/২০২০ইং তারিখে বিদেশী পরিবারটি অভিভাবক সেজে শিল্পীকে লালমনিরহাট শহরের মিশনমোড়স্থ বৈশাখী ক্লিনিকে ভর্তি করান। ক্লিনিকের রেকর্ড অনুযায়ী শিল্পী বেগমের ওইদিন সিজারের মাধ্যমে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন। জম্মধারীনি মা সুস্থ হওয়ার পর থেকে দেখেন তার কাছে সন্তান নেই। দুখিনী মা ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরেন সন্তান ছাড়াই।
এরমধ্যে শিল্পীর স্বামী কুড়িগ্রাম থেকে বাড়িতে আসেন। দেখেন তার স্ত্রী কাছে সদ্য ভুমিষ্ট সন্তান নেই। সন্তানের কথা জানতে চাইলে শিল্পী কোন উত্তর দিতে পারেননি স্বামীকে। শুধু কান্নায় করেন। আর এনিয়ে স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া লেগেই থাকত। অনেক চেষ্টা করার পরেও একনজর সন্তানকে দেখতে বার বার বিদেশীর বাড়ি যাওয়া আর আসার মাঝে কেটে যায় দীঘ ৫ মাস ২৪ দিন। অর্থাৎ ১৭৪ দিন পর একজন সমাজকর্মী জয়িতা ও প্রশাসনের সহযোগীতায় সন্তান ফিরে পেলেন মা শিল্পী বেগম।
দীঘদিন প্রতীক্ষার পর বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) রাত ৯ টায় লালমনিরহাট সদর থানা পুলিশ উদ্ধার সন্তানটিকে হস্তান্তর করেন বলে অশ্রুসিক্ত নয়নে মা শিল্পী বেগম এ প্রতিবেদককে জানান। তিনি আর জানান, রহস্যজনক কারণে ১৭৪ দিন পর চুরি যাওয়া শিশুটি উদ্ধারের ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। ফলে তারা আবারও আমার বাড়িতে এসে সন্তানটি জোড় করে নেওয়ার পায়তারা করছেন।
সন্তান ফিরে পেয়ে মা শিল্পী বেগম বলেন, আমি আমার সন্তান (পোষানী) দত্তক দেয়নি। আনোয়ারুল বিদেশী চেয়েছিল, আমি রাজি হয়নি। আমি ক্লিনিকে অসুস্থ থাকাবস্থায় আমার বাচ্ছাটিকে নিয়ে গেছে। পরে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সমাজকর্মী জয়িতা রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা আপার সহযোগিতায় আজকে আমার হৃদয়ের শূন্যতা পূরন হলো। আমার সন্তানকে ফিরত পেলাল। আমার যে আজকে কত খুশি সেটা বলে বুঝাতে পারবো না।
ওই সময় উপস্থিত ছিলেন, লালমনিরহাট সদর থানার অফিনার ইনচার্জ (ওসি) শাহা আলম, পৌরসভা ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোকছেদুর রহমান মুকুল, সমাজকর্মী জয়িতা রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তাসহ অনেকেই।
সমাজকর্মী জয়িতা মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা বলেন, এরআগে এক ছাত্রীর সহযোগীতায় ৪ সন্তানের জননী মোছাঃ শিল্পী বেগমের সদ্য ভুমিষ্ট সন্তান ক্লিনিক থেকে চুরি যাওয়ার বিষয়টি আমাকে জানান। বিষয়টি শুনে আমি হবাক। আমার সহযোগীতায় মোছাঃ শিল্পী বেগম বাদী হয়ে ২৭/০৩/২১ইং তারিখে লালমনিরহাট সদর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অবশেষে বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) লালমনিরহাট সদর থানা পুলিশ মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের সাতপাটকী এলাকা একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের নিকট থেকে শিশু সন্তানটিকে উদ্ধার করেন। তবে, কার নিকট থেকে সন্তানটিকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের নাম ও ঠিকানা জানায়নি প্রশাসন।
সমাজকর্মী জয়িতা মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা আরও বলেন, আমি যখন খোঁজ পাই একজনের সন্তান অন্যজন অবৈধভাবে নিয়েছে। সেটা আমার হৃদয়ে আঘাত হানে। তখন থেকে সন্তানকে তার নিজের মায়ের কাছে ফেরত পাওয়ার জন্য কার্যক্রম শুরু করি। অবশেষে ১৭৪ দিন পর প্রশাসনের সহযোগীতায় সন্তান ফিরে পেলেন এক অসহায় মা শিল্পী বেগম। এখন তার আনন্দেই আমার অনেক ভাল লাগে। এটাই আমার কাজের স্বার্থগতা।
এ ব্যাপারে লালমনিরহাট সদর থানার অফিনার ইনচার্জ (ওসি) শাহা আলম বলেন, বাচ্চা চুরি কোন ঘটনা ঘটেনি, তাই মামলা হয়নি। বাচ্ছাটিকে অভাবের তাড়নায় তার মা নিজেই দত্তক দিয়ে ছিলেন। কিন্তু বাচ্ছা দত্তক নেওয়ার নিয়মকানুন না মানায় বাচ্ছাটিকে উদ্ধার করে তার মার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।