স্টাফ রিপোর্টার।। প্রায় সাড়ে ৬ দশক পার হয়ে গেলেও তৈরি হয়নি ভাষা সৈনিকদের পুর্ণাঙ্গ নামের তালিকা। এ নিয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা দেয়ার দশ বছরেও কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলা ভাষার গৌরবের আন্দোলনে সম্পৃক্তদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। ওই রিটের প্রেক্ষিতে নির্দেশনাও দেয়া হয়। পরে ২০১১ সালের ২০শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি এক বছর পরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়া ১৪ নারীসহ জীবিত ৬৮ জনকে ভাষাসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশ করে। তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেখানে কিছু নামে তৈরি হয়েছিলো বিতর্ক।
এমন অভিযোগে এ তালিকা প্রণয়ের কাজটি স্থগিত করা হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকাসহ দেশের সকল জেলায় কমিটি গঠন করে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। শুরুতেই জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করতে আদালতের কাছে আবেদন জানানো হয়। কমিটি সূত্র জানায়, মূলত দুটি বিষয় মাথায় রেখে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। একটি হচ্ছে, যারা ভাষা আন্দোলন সংগঠিত রাখার কাজে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন, অর্থাৎ যাঁরা ভাষা সংগঠক। অপরটি হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের কারণে যারা কারাবরণ করেছেন। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভাষা সৈনিক আহমদ রফিককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল শুধু ঢাকায়। কমিটিতে আরও ছিলেন রফিকুল ইসলাম ও মুনতাসীর মামুন।
কিন্তু সেই কমিটির মাত্র একটি বৈঠক হয়েছিল, যাতে কাজের পদ্ধতির জটিলতা নিয়েই শুধু আলোচনা হয়। এরপর থেকে তালিকা প্রণয়নে কাজটি কার্যত বন্ধ রয়েছে। ওই কমিটির সদস্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ভাষা সৈনিকদের সবার তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তখন লাখ লাখ মানুষ মিছিলে গিয়েছেন, আন্দোলন করেছেন। সবার লিস্ট তো তেমন ভাবে সংরক্ষন নেই কারো কাছে। কিন্তুযারা একটু প্রমিনেন্ট, শহীদ হয়েছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকেই লিষ্টে রাখার সুপারিশ করেছিলাম। এদিকে উচ্চ আদালতে রিটকারী আইনজীবী মনজিদ মোরশেদ বলেন, রুল জারি হওয়ার পর তারা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু পুর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করার জন্য পদক্ষেপ না নেয়ায় আমরা দুই বার কনটেম্প পিটিশন ফাইল করেছি। ফলে তখনকার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ব্যক্তিগত হাজিরা দিয়েছিলেন। বাকি তালিকা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা তালিকা পাইনি। আমরা মন্ত্রণালয়ে কয়েকবার যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে, তালিকা করার জন্য যে কমিটি ছিলো তারা অপারগতা প্রকাশ করেছে। পরে আমরা মন্ত্রীকে বলেছি এই কমিটি না হলে নতুন করে কমিটি করে দেয়ার জন্য। কিন্তু এর পর আর কমিটি ঘোষণা হয়নি।
উচ্চ আদালতের রুলে ভাষাসৈনিকদের তালিকা তৈরি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে একটি গ্রন্থাগার ও ভাষা জাদুঘর নির্মাণসহ আট দফা নির্দেশনা ছিল। পঞ্চম দফা নির্দেশনা ছিল ভাষাসৈনিকদের তালিকা তৈরি করা। কিন্তু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশের গ্রন্থাগার ও ভাষা জাদুঘর নির্মাণের কাজটিও সাইনবোর্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশিত তালিকা তৈরি কমিটির আহ্বায়ক ও একুশের চেতনা পরিষদের সভাপতি ভাষা সৈনিক আহমদ রফিক বলেন, আমি যতটুকু জানি কয়েকদিন আগে হাইকোর্ট জাতীয় জাদুঘরকে দুই বছরের মধ্যে এই তালিকা প্রকাশ করার আদেশ দিয়েছে। কিন্তু আমি নিজ উদ্যোগে এখন পর্যন্ত ২২৫-৩০ জনের মতো একটি তালিকা করেছি। কিন্তু আমার শারীরিক অবস্থা তেমন একটা ভালো না, চোখে দেখতে পারছি না। তাই তালিকাটা এগোতে পারছি না। তবে আর্থিক সহযোগিতা পেলে ব্যক্তিগতভাবে এই কাজ শেষ করে যেতে চান তিনি। তিনি বলেন, সরকারি উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র সংরক্ষণ, সংকলন বা ইতিহাস ধরে রাখার জন্য কিছুই হয়নি। এমনকি বর্তমানে ইচ্ছে থাকলেও আর সেটা করা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের বন্ধু-বান্ধব যারা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই আজ নেই। আমার মতো দু’চারজন বেঁচে আছেন। এসব বিষয় নিয়ে সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এই কাজটা আগেও হয়নি ,আমরাও করতে পারিনি। হাইকোর্টের যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলো সেখানে ভাষা সৈনিকদের কোনো সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়নি।
কাদেরকে কিভাবে ভাষা সৈনিক বলবো তার কোনো রূপরেখা করে দেয়া হয়নি। সে সময়ে অনেকেই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো। কিন্তু তাদের লিষ্ট তেমন ভাবে কোথাও হয়নি। যেমনটা হয়েছিলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এ খালিদের কাছে উচ্চ আদালনের নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রক্রিয়াটির বিষয়ে তিনি পুরোপুরি অবগত নন। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানান তিনি