ঢাকাশনিবার , ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
  1. Covid-19
  2. অপরাধ ও আদালত
  3. অর্থনীতি
  4. আন্তর্জাতিক
  5. ইসলাম ডেস্ক
  6. কৃষি ও অর্থনীতি
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয়
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. দেশজুড়ে
  11. নির্বাচন
  12. বানিজ্য
  13. বিনোদন
  14. ভিডিও গ্যালারী
  15. মুক্ত মতামত ও বিবিধ কথা
আজকের সর্বশেষ সবখবর

কোচিং বাণিজ্য জমিয়ে তুলতেই প্রশ্ন ফাঁস, যোগসাজশে শিক্ষা কর্মকর্তা-মৎস্য কর্মকর্তা!

প্রতিবেদক
প্রতিদিনের বাংলাদেশ
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২ ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

রাশেদুল ইসলাম রাশেদ,স্টাফ রিপোর্টারঃ
কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থী টানার জন্য লুৎফর রহমান ও তাঁর সহযোগীরা এর আগেও প্রশ্ন ফাঁসের কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। ফাঁস করা প্রশ্ন আশপাশের কয়েকটি কোচিং সেন্টারেও সরবরাহ করতেন তাঁরা। প্রতিদিনের বাংলাদেশ এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন ফাঁসের জোরালো অভিযোগ উঠলেও, উল্টো তিনিই প্রশ্ন ফাঁসের মামলার বাদী হয়ে ‘সাধু’ সেজেছেন।
মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও ট্যাগ অফিসার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সই ছাড়া থানায় সংরক্ষিত প্রশ্নের ছয়টি প্যাকেট কেন্দ্র সচিবের একার পক্ষে খোলার সুযোগ নেই।

অনুসন্ধান ও বিস্তারিতঃ কোচিং ব্যবসা জমিয়ে তুলতেই প্রশ্ন ফাঁসে জড়িয়েছিলেন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান। বিদ্যালয়েই তিনি কোচিং সেন্টার খুলে বসেন। প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে নামহীন ওই কোচিং সেন্টারের ক্লাস শুরু হতো। পরীক্ষায় ভালো ফল পাইয়ে দিতে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হতো নিশ্চয়তা। কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থী টানার জন্য লুৎফর রহমান ও তাঁর সহযোগীরা এর আগেও প্রশ্ন ফাঁসের কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। ফাঁস করা প্রশ্ন আশপাশের কয়েকটি কোচিং সেন্টারেও সরবরাহ করতেন তাঁরা। প্রতিদিনের বাংলাদেশ এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।

বিষয়টি স্বীকার করে কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামসুল আলম বলেন, কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত ছিলেন অভিযুক্তরা। তাঁরা দুই ভাগে বিদ্যালয়ে কোচিং সেন্টার চালাতেন। মূলত কোচিংয়ে ছাত্রছাত্রী টানতেই তাঁরা প্রশ্ন ফাঁস করেন।

এদিকে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় কেন্দ্র সচিবসহ তিন শিক্ষকের পাশাপাশি অন্তত দুই সরকারি কর্মকর্তার যোগসাজশের প্রমাণ মিলেছে। তাঁরা হলেন ভূরুঙ্গামারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান, একই উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরী। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। তাদের প্রাথমিক তদন্তে ওই দুই কর্মকর্তার সংশ্নিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানকে বৃহস্পতিবার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

প্রশ্ন ফাঁসের মামলায় আরও তিন শিক্ষক-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন- ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম, বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল চৌধুরী ও পিয়ন সুজন মিয়া। গত বুধবার সকালে হামিদুল ইসলাম ও সোহেল চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। পরে তাঁদেরকে মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পিয়ন সুজনকেও আটক করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এদিকে, স্থগিত চার বিষয়ের পরীক্ষার নতুন সময়সূচি ঘোষণা করেছে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড। নতুন সূচি অনুযায়ী এসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১০ থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে। এ ছাড়া ফাঁসের ঘটনায় জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতের প্রশ্ন গতকাল বাতিল করা হয়েছে। তবে প্রশ্ন বাতিল হলেও যথাসময়ে ওই দুটি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর জীববিজ্ঞান এবং ১ অক্টোবর উচ্চতর গণিতের পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে।

অভিযুক্তরা বিদ্যালয়েই চালাতেন কোচিং :ধুন্ধুমার কোচিং ব্যবসা করতে শুধু এবার নয়; কয়েক বছর ধরেই এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান। প্রশ্ন ফাঁস করে টাকা আয় ছাড়াও অন্য স্কুলের চেয়ে ভালো ফল করাও ছিল তাঁর লক্ষ্য। প্রশ্নপত্রের মোড়ক বদল হওয়ায় পুরো প্যাকেট নিতে গিয়ে এবার বিষয়টি ধরা পড়ে।
অতিরিক্ত ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীদের স্কুলে কোচিং করতে বাধ্য করতেন কোচিং-সংশ্নিষ্ট শিক্ষকরা। এ জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হতো শিক্ষার্থীদের। সেই টাকার ১০ শতাংশ পেতেন প্রধান শিক্ষক লুৎফর। স্কুলের ভেতর পরিচালিত দুটি কোচিংয়ের সমন্বয় করতেন শিক্ষক জোবায়ের।

শিক্ষকরা জানান, স্কুল ভবনেই অতিরিক্ত ক্লাসের নামে নেওয়া হতো কোচিং ক্লাস। পরীক্ষার সময়ও এ ঘটনার আগ পর্যন্ত দুপুর ২টা থেকে ক্লাস নিতেন তাঁরা। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সব শিক্ষার্থীকে করতে হতো বাধ্যতামূলক কোচিং। তা না হলে তাদের পরীক্ষার ফল খারাপ করে দেওয়া হতো।

তবে এ বিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহকারী শিক্ষক লুৎফর রহমান দাবি করেন, কোচিং ছিল না। ভালো ফলের জন্য অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া হতো আর কি। সেখানে ক্লাস নিতেন চার শিক্ষক। তাঁরা হলেন- হামিদুল, রাসেল, জোবায়ের ও আল মামুন সোহেল। শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বিষয়গুলো আমরা কখনও জানতাম না। কখনও জানার চেষ্টা করিনি। আমাদের দায়িত্ব দিত কক্ষ পরিদর্শকের। আরও কয়েকজন শিক্ষক জানান, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত দুপুর ২টার পর থেকে কোচিং চলত। এখন তা বন্ধ রয়েছে।

স্কুলের কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিদিনের বাংলাদেশের। তাঁদের দু’জনের মেয়ে ওই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, মাসে ৩ হাজার টাকা নিয়ে তাঁরা অতিরিক্ত ক্লাস নিতেন। ভর্তির সময় প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্নিষ্ট শিক্ষকরা ভালো ফলের নিশ্চয়তা দিতেন।

এজাহার ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান বাংলা প্রথম পত্র ও ইংরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষার দিন গোপনে ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নের প্যাকেট নেন। তাঁর কোচিংয়ের শিক্ষক জোবায়ের, সোহেল, হামিদুল ও রাসেলকে দিয়ে হাতে লিখে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন এলাকায় টাকার বিনিময়ে হাতে লেখা প্রশ্ন সরবরাহ করেন। আশপাশের কোচিং সেন্টারেও তাঁরা ওই প্রশ্ন বিক্রি করেন।

ভূরুঙ্গামারীর ঘটনার পর প্রশ্নপত্র সংরক্ষণ ও সরবরাহ পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কয়েকজন শিক্ষক বলেন, এক দিনে অনেক প্রশ্নপত্রের প্যাকেট যাচাই-বাছাই করতে হয়। সে তুলনায় লোকজন কম থাকায় সহজে প্রশ্ন ফাঁসের সুযোগ থাকে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা ও মৎস্য কর্মকর্তাও জড়িত :শিক্ষা বোর্ডের তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, দুই সরকারি কর্মকর্তার কাজে গাফিলতি ও যোগসাজশ না থাকলে কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমানের পক্ষে একা প্রশ্ন ফাঁস কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও ট্যাগ অফিসার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সই ছাড়া থানায় সংরক্ষিত প্রশ্নের ছয়টি প্যাকেট কেন্দ্র সচিবের একার পক্ষে খোলার সুযোগ নেই। এ থেকেই ওই দুই কর্মকর্তার যোগসাজশের বিষয়টি ধরা পড়ে। কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তের আদেশে তাঁর বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্যদিকে, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ উঠলেও উল্টো তিনিই প্রশ্ন ফাঁসের মামলার বাদী হয়ে ‘সাধু’ সেজেছেন।

হয়েছিল ধামাচাপার চেষ্টাও : মঙ্গলবার প্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ধরা পড়লেও সেদিনই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ধামাচাপার চেষ্টা হয়েছিল। তবে বুধবার তা জানাজানি হলে মামলা হয়। আগের দিন প্রশ্ন ফাঁসের খবর পেয়ে সন্ধ্যায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ভূরুঙ্গামারী যান। সেখানে তাঁরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে বিষয়টি তদন্ত করেন। সেখান থেকে শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান থানায় গিয়ে শিক্ষকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আবারও ইউএনও কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যান। বৈঠকের সময় ইউএনও কার্যালয় ও থানা কার্যালয়ের মূল ফটকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। রাত ৮টা থেকে চার ঘণ্টার বৈঠক শেষ রাত ১২টার পরে বের হন তাঁরা।

স্থগিত পরীক্ষার নতুন সূচি : স্থগিত হওয়া চারটি বিষয়ের পরীক্ষার নতুন সময়সূচি প্রকাশ করা হয়েছে। পরিবর্তিত সূচি অনুযায়ী আগামী ১০ অক্টোবর গণিত (আবশ্যিক), ১১ অক্টোবর কৃষি শিক্ষা (তত্ত্বীয়), ১৩ অক্টোবর রসায়ন (তত্ত্বীয়) ও ১৫ অক্টোবর পদার্থবিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া ব্যবহারিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ১৬ থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত।

আরও দুই বিষয়ের প্রশ্ন বাতিল : ফাঁসের ঘটনায় জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিত বিষয়ের প্রশ্নও বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হওয়া প্রশ্ন আলাদা ট্রাঙ্কে করে সংরক্ষণের জন্য রংপুর বিভাগের আট জেলার জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করা হয়েছে। তবে প্রশ্ন বাতিল হলেও যথাসময়ে ওই দুটি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল ইসলাম জানান, বাতিল হওয়া নতুন দুটি বিষয়ের প্রশ্ন ও আগের স্থগিত করা চারটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ইতোমধ্যেই ছাপানো শুরু হয়েছে। আগামী সোমবারের মধ্যেই জেলা প্রশাসকের ট্রেজারিতে সেসব প্রশ্ন চলে যাবে।
রাশেদুল ইসলাম রাশেদ/আরইসআর

আপনার মন্তব্য লিখুন