আরিফুজ্জামান তুহিন:ডলারের অভাবে জ্বালানিসংকট তীব্র হয়েছে। এতে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। মজুত কয়লা দিয়ে পায়রার ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট চলবে আগামীকাল সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত। এরপর কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে নতুন কয়লায় কেন্দ্রটি চালু হতে সময় নেবে ২৫ জুন পর্যন্ত। বর্তমানে দেশে ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং। জুনের ২৫ তারিখের আগে লোডশেডিং দূর হবে না বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের মত। তাই এই গ্রীষ্মে লোডশেডিংয়ে ভুগতে হবে আরও অন্তত ২২ দিন।
আগামী পাঁচ দিন দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু ও তীব্র দাবদাহ অব্যাহত থাকবে। এসব এলাকায় দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ সময় বড় বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। ফলে লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল শনিবার টেলিফোনে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘জ্বালানির সংকট রয়েছে। আমরা জ্বালানিসংকট কাটাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কাতার থেকে এলএনজি আমদানি দ্বিগুণ করার চুক্তি করেছি। পায়রার বকেয়া কয়লার টাকা পরিশোধ করেছি। এর পরও জুনের শেষ সপ্তাহের আগে লোডশেডিং কমানো যাবে না। কারণ এসব জ্বালানি দেশে আসতে আসতে জুনের শেষ সপ্তাহ নাগাদ লেগে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক জ্বালানিসংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছি। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ রয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছি। আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি সংকট সমাধানের।’
পায়রা বন্ধ হবে সোমবার মধ্যরাতে:
কয়লার অভাবে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে গত ২৫ মে। দ্বিতীয় ইউনিটটি আগামী সোমবার দিনগত রাত ১২টার দিকে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠান প্রিটি বায়ান্সের কাছে কয়লার চাহিদা পাঠানো হয়েছে। জাহাজও রওনা দিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার বন্দরে। তার পরও সব মিলিয়ে আগামী ২৫ জুনের আগে পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঘাটে এসে জাহাজ ভিড়বে না। এ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে কেন্দ্রটি।
জানা গেছে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জ্বালানি খরচ হচ্ছে মাত্র সাড়ে ৫ টাকা। এটিই আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বনিম্ন খরচ।
এ বিষয়ে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক শাহ গোলাম মাওলা টেলিফোনে গতকাল দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের মজুত দিয়ে টেনেটুনে আগামী সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত চলতে পারে। আমরা সন্ধ্যার পিক আওয়ারে ৬২০ মেগাওয়াট করে দিচ্ছি। আর অন্য সময় কেন্দ্রটি থেকে ৩০০ থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি। নতুন কয়লা আসতে আসতে ২৫ জুন পর্যন্ত লেগে যাবে। সোমবারের পর কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাবে।’
প্রসঙ্গত, চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমসি ছয় মাসের বাকিতে কয়লা সরবরাহ করত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। সংস্থাটির ৯ মাসের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার কয়লার বিল বাকি পড়ায় চীনা মুদ্রা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে কয়লা সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সম্প্রতি সরকার প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা কয়লার বিল পরিশোধ করায় চীনের মুদ্রা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে কয়লা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এর পরই ইন্দোনেশিয়ার যে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কয়লা আনা হয়, সেই প্রিটি বায়ান্সকে কয়লা সরবরাহের আদেশ দেয়া হয়। কয়লা পরিবহনের জাহাজকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এর পরও কয়লা পায়রা বন্দরে ২৫ জুনের আগে পৌঁছাবে না।
২৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং:
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গড়ে ঘণ্টাপ্রতি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের পরিস্থিতি খোদ ঢাকায় অসহনীয় হয়ে উঠেছে। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর ধানমন্ডিতে পাঁচবার বিদ্যুৎ চলে যায়। প্রতিবার ১ ঘণ্টা পরে বিদ্যুৎ এসেছে। এই এলাকাটিতে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) বিদ্যুৎ বিতরণ করে থাকে।
ঢাকার বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চেয়ে দেশের জেলা, থানা ও গ্রাম পর্যায় আরও খারাপ অবস্থা। দেশের বিভিন্ন এলাকার খবর থেকে জানা যাচ্ছে, দিন ও রাত মিলিয়ে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না। এসব এলাকায় মধ্য রাতেও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে মৃদু থেকে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। এটি আগামী আরও চার-পাঁচ দিন বয়ে যেতে পারে। রাজশাহী, নওগাঁ, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলাগুলোর ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং মৌলভীবাজার, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলাগুলোর ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে এ সময়।