দশক চারেক আগের কথা। প্রাইমারি স্কুলে পড়তো মামুন। বাবা জীবিত না থাকায় স্কুলে যাওয়ার বয়স হলেও টের পাননি তার মা। বছরের মাঝামাঝি একদিন সকাল বেলা, জ্যাঠাতো বোন হেতিজা স্কুলে যাওয়ার পথে মামুনকে বলে, ‘আমার সাথে স্কুলে যাবি?’ স্কুল আবার কী! বুঝতে পারে না সে। জবাব না পেয়ে স্কুলের পথ ধরে বুবু। কয়েক কদম যেতেই একটা জোরে ডাক দেয় সে বুবু দাঁড়াও, আমিও যাব। বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় বুবুর স্কুল। গায়ে ছিল সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। ওই অবস্থায় দৌড় দেয় বুবুর কাছে।
বুবুর সাথে ছোট্ট পায়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছল শৈশব জড়িয়ে থাকা সেই স্কুলে। সাথে ছিল না কোনো বই, শ্লেট ও লেখার চক বা পেন্সিল। তখনো বুঝতে পারেনি সে লেখাপড়ার জন্য এগুলো অত্যাবশ্যক। বুবু পাঠ্যবইগুলো নিজ ক্লাস রুমে রেখে তাকে নিয়ে যায় প্রথম শ্রেণির ক্লাস রুমে। পিছনের বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে ফিরে যায় সে।
ক্লাসে বসে অবাক হয়ে যায় মামুন। সেখানে তার মতো ছোট ছোট যে অনেক ছেলেমেয়ে! কিন্তু কাউকে চেনে না সে। হাবাগোবার মতো বসে থেকে দেখতে থাকে বন্ধুদের হৈ হুল্লোর আর কে, কাকে সরাতে পারে সেজন্য বিপরীত মুখী বেঞ্চে বসে জোরে ঠেলাঠেলি। সেই ঠেলাঠেলিতে বেঞ্চ হতে শানের(পাকা) মেঝেতে পড়েও যাচ্ছে কেউ কেউ। এমন ঠেলাঠেলি আর হৈ হুল্লোর দেখে মন্দ লাগছিল না তার। সহপাঠীদের সাথে ছোট্ট মানুষটির মিল হতে সময় লাগেনি বেশিক্ষণ। সেও মেতে ওঠে হুড়োহুড়ি আর ঠেলাঠেলিতে।
স্কুলের চারপাশ মুসলিম ও হিন্দু অধ্যুষিত এবং নিকটবর্তী অন্যকোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় প্রায় সব ছেলেমেয়েই পড়তো পুরোনো ওই স্কুলে। সাথে পড়তো রঞ্জিত দাশ, লড়াই দাশসহ অনেকেই। ভালোই কাটছিল লেখাপড়ার পাশাপাশি সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলা করে। প্রাইমারির পাঠ চুকিয়ে মামুনসহ কয়েকজন স্থানীয় সরকারি হাইস্কুলে ভর্তি হলেও অন্যান্যরা গেল ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে। কিন্তু অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে গেল রঞ্জিতের পড়াশোনা। পরে বন্ধুদের মধ্যে মামুনসহ দুই একজন উচ্চ শিক্ষা অর্জন করলেও অনেকেরই আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যে যার যার মতো করে বেছে নিয়েছে বিভিন্ন পেশা। তাদের মধ্য কেউ শ্রমিক, কেউ রিকসা, কেউ বা করছে ব্যবসা।
পেশায় ভিন্নতা থাকলেও সহপাঠীদের সাথে দেখা হলে বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না সে। কথাও হয় হাসিমুখে। চলে চায়ের আড্ডা আর সুখ-দুঃখের নানা গল্প। একদিন ভোরে হাঁটতে বেড়িয়েছে মামুন। হঠাৎ দেখা হয়ে যায় রঞ্জিতের। কথা বলতে বলতে ইঙ্গিত করে ওর বাসায় যেতে। অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় বন্ধুর কথা ফেলতে পারে না সে। বসতে দেয় রঞ্জিত। পরিচয় করিয়ে দেয় তার সন্তানদের সাথে। অবাক হয়ে যায় তারা। বাবার বন্ধু! সম্বল বলতে ৩ শতক জমি। ঘুরে ঘুরে দেখায় সেই জায়গায় সরকারি বরাদ্দ পাওয়া ঘরটি। তবে নেই কোনো খাট বা চৌকি। ঘরটি নিতে নাকি গুণতে হয়েছে তাকে —। তবুও চোখে মুখে অস্ফুট হাসির ছাপ।
মামুনের মনে পড়ে বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের সেই মানবিক বাণী, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
মনে পড়ে সহীহ বুখারীর সেই হাদিসের কথা, ‘আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করবেন না, যারা মানুষ জাতির প্রতি দয়াবান নয়।’
রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় সে। আবার হাঁটতে শুরু করে মামুন আর আনমনে বলতে থাকে পেশা, ধর্ম, বর্ণ যাই হোক ‘তবুও বন্ধু।’
লেখকঃ
এম এ মাসুদ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
masud.org2018@gmail.com