ঢাকামঙ্গলবার , ১ ডিসেম্বর ২০২০
  1. Covid-19
  2. অপরাধ ও আদালত
  3. অর্থনীতি
  4. আন্তর্জাতিক
  5. ইসলাম ডেস্ক
  6. কৃষি ও অর্থনীতি
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয়
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. দেশজুড়ে
  11. নির্বাচন
  12. বানিজ্য
  13. বিনোদন
  14. ভিডিও গ্যালারী
  15. মুক্ত মতামত ও বিবিধ কথা
আজকের সর্বশেষ সবখবর

কৃষক কাঁদছে ভোক্তা জ্বলছে!

প্রতিবেদক
প্রতিদিনের বাংলাদেশ
ডিসেম্বর ১, ২০২০ ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

স্টাফ রিপোর্টারঃ লালমনিরহাটের একজন কৃষক এক কেজি মুলা বিক্রি করছেন ১০ থেকে ১৫ টাকা দরে। রাজধানীর ঢাকায় একজন ভোক্তা সেই মুলা কিনছেন প্রতি কেজি ৫০-৬০ টাকায়।

শীতের অন্যতম সবজি লাউ ভালো উৎপাদন হয় মানিকগঞ্জে। সেখানকার তথ্য বলছে, লাউয়ের চাহিদা এখনো সেখানে রয়েছে। তবে দাম কম। গতকাল পর্যন্ত সেখানকার কৃষকরা প্রতিটি লাউ বিক্রি করেছেন ১২-১৫ টাকা দরে। এই লাউ গতকাল কারওয়ান বাজারে আড়তদারের মাধ্যমে ব্যাপারীরা (পাইকারি) বিক্রি করেছেন ৩০-৩৫ টাকা। আর খুচরা বাজারগুলোতে বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকা। শুধু মুলা ও লাউ নয়, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপির ক্ষেত্রেই কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে দামের এমন আকাশ-পাতাল তফাত রয়েছে।

বিভিন্ন এলাকার কৃষক থেকে ঢাকায় ভোক্তা পর্যায়ে আসতে স্থানভেদে পাঁচ থেকে ছয়টি হাত বদল হচ্ছে। এই হাত বদলে মুলার দাম বাড়ছে ২০ গুণ, লাউয়ের দাম বাড়ছে তিন গুণের বেশি। এভাবে অন্য সবজির ক্ষেত্রে অনেক গুণ দাম বেড়ে যায়।

দামের এমন পার্থক্য হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, হাত বদলে মুনাফা ছাড়াও খাজনা ও স্থানভাড়া, শ্রমিক খরচ, পরিবহন খরচ, পথে পথে পুলিশ, পৌরসভা ও বিভিন্ন সংগঠনের চাঁদাবাজি, অতিরিক্ত ফেরি ভাড়া ইত্যাদি। ব্যাপারী থেকে খুচরা পর্যায়ে সরবরাহকারীরাই সবজির চূড়ান্ত দাম ঠিক করে দেয়, যেখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেখা যাচ্ছে কেউ বিনিয়োগ না করেও টাকা তুলে নিচ্ছে। যারা বিনিয়োগ করছে, অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগী, তারা বেশি মুনাফা করছে।
সরবরাহ সারির প্রথম ব্যক্তি কৃষক ও সর্বশেষ ব্যক্তিটি হলো ভোক্তা। দাম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই দুই শ্রেণির মানুষই দিনের পর দিন ঠকে যাচ্ছে। কৃষক উৎপাদনে যে খরচ করেন সবজির ভরা মৌসুমে ব্যাপক প্রতিযোগিতায় সে খরচটুকুও অনেক সময় অনেক পণ্যে পান না। নামে মাত্র দামে তাঁকে পণ্য বিক্রি করতে হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ঠকে ভোক্তা। কারণ কৃষক যে দামে বিক্রি করেন ভোক্তাকে কিনতে হয় তার কয়েক গুণ বেশি দামে।

দেশে সবজির বড় উৎস যশোর, পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর, পঞ্চগড় ও কুষ্টিয়া। বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীতে সবজি নিয়ে আসা এবং হাত বদলের পর্যায়গুলো অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, কিভাবে সস্তার মুলা ভোক্তা পর্যায়ে উচ্চ মূল্যের হয়ে যাচ্ছে।

লালমনিরহাটের একজন কৃষকের কাছ থেকে দেড় থেকে দুই টাকায় কিনে স্থানীয় ফড়িয়ারা সেটি বিক্রি করেন কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা দরে। প্রথম দফার হাত বদলেই দাম বেড়ে গেল কেজিতে তিন টাকা। ফড়িয়ার কাছ থেকে সবজি চলে যায় স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাতে। তখন বাড়ে আরো পাঁচ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সবজি চলে যায় রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে। ঢাকায় আসার পর কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর বড় বড় সবজির আড়তে আসে। বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় আসার পথে সড়কে বেশ কয়েক জায়গায় পৌরসভার পক্ষ থেকে টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজি, পরিহন শ্রমিকসহ বিভিন্ন সংগঠন, হাইওয়ে পুলিশ ও থানা পুলিশের নামে কয়েক ধাপে চাঁদাবাজি হয়। যে কারণে খুচরা বাজারে যাওয়ার আগেই মুলা দাম বেড়ে যায় কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা।

কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কৃষকরা স্থানীয় আড়তদার বা দালালদের কাছে সবজি বিক্রি করেন। তাঁরাই ঢাকার আড়তদারদের সরবরাহ করেন। ফলে পরিবহন খরচসহ প্রতি কেজিতে ৭-১০ টাকা বাড়তি খরচ হয়। ঢাকার আড়তদারদের কাছ থেকে পাইকাররা নিয়ে যান, তাঁরা বিক্রি করে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে।

কারওয়ান বাজারের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন জেলা থেকে সবজি ঢাকায় আনতে ট্রাকভাড়া, চাঁদাবাজি ও আড়তের কমিশন এবং পণ্য ওঠানো-নামানোতে প্রায় প্রতি কেজিতে ১০-১২ টাকা খরচ আছে। তারপর ফড়িয়া ও খুচরা ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে মানুষের কাছে পৌঁছতে দাম বেড়ে যায়।

গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচা, মালিবাগ ও মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন খুচরা বাজারে মুলা বিক্রি হয়েছে ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে।

রাজধানীর সাপ্লাই চেইনে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। রাজধানীর খুচরা বিক্রেতারাও অনেক সময় সরাসরি আড়ত কিংবা ব্যাপারীর কাছ থেকে সবজি কেনেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের খরচ পড়ে আরো কম। আবার অনেক পাইকার নিজেই কারওয়ান বাজারের মতো বড় বাজারগুলোতে সবজি বিক্রি করেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা পাঁচ কেজির পাল্লা হিসেবে বেচেন। পাইকারি বাজারগুলোর এসব বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায় ভোরের মধ্যেই।

একসময় ঢাকার বাজারগুলোতে শিমের দাম ছিল প্রায় দেড় শ টাকার কাছাকাছি। এখন ৪৫-৫০ টাকা কেজি পাওয়া যায়। দাম কমার পরও ভোক্তা কিন্তু ঠিকই ঠকছে। কারণ ব্যাপারীরা এই শিম কৃষকদের কাছ থেকে কিনে আনছেন মাত্র ২০ থেকে ২১ টাকা কেজি। আর আড়তদার বিক্রি করছেন ২৯ থেকে ৩০ টাকা কেজি। অর্থাৎ ভোক্তার কাছে আসার আগেই দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। রংপুরের কৃষক বাঁধাকপি বিক্রি করছেন আট টাকা থেকে ১৫ টাকা করে প্রতিটি। ঢাকায় খুচরা বাজারে ব্যবসায়ীরা রাখছেন ২৫ থেকে ৩৫ টাকা করে। মাঝ খানে ব্যাপারী আর আড়তদার বিক্রি করছেন ১৫-১৮ টাকা করে। এ ক্ষেত্রে দ্বিগুণ দাম। একই অবস্থা ফুলকপিতে। নওগাঁর কৃষকরা ফুলকপি বিক্রি করছেন ১০ থেকে ১৫ টাকা করে। ব্যাপারী ও আড়তদার মিলে বিক্রি করছেন ১৮ থেকে ২০ টাকা করে। আর খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ২৫ থেকে ৩৫ টাকা পিস।

এই সাপ্লাই চেইনে যারা থাকে তারা যে দাম নির্ধারণ করবে সে দামেই কৃষককে বিক্রি করতে হয়। কারণ এখন পর্যন্ত কৃষকের দৌড় ওই পর্যন্তই। আর ব্যাপারী ও আড়তদার মিলে যে দাম ঠিক করবেন, সেই দামেই কিনতে হবে খুচরা বিক্রেতাদের। অর্থাৎ সাপ্লাই চেইনে আড়তদার ও ব্যাপারীর সিন্ডিকেটের শক্তিটাই সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে আড়তদারদের প্রথম দাবি হলো খুচরা ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ায়। আর আড়ত পর্যায়ে যেটুকু বাড়ে তা নানা ধরনের খরচের কারণে বাড়ে।

কারওয়ান বাজারের ব্যাপারী হাশমত মিয়া দাম বাড়ার ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে—মাল কেনার পর মোকামগুলোতে খাজনা, মাল ওঠানো-নামানোর খরচ, পরিবহন ভাড়া, আড়তদারের কমিশন, পথে ও বাজারগুলোতে বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক চাঁদা যোগ হয় প্রতি কেজি পণ্যে। তাঁর হিসাবে প্রতি পিস লাউয়ের পরিবহন ভাড়াই পাঁচ টাকা পড়ে। এসব খরচ যোগ করে তারপর নিজের মুনাফাও ধরতে হয়।

তবে কারওয়ান বাজারের কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টারের দাবি, আড়তদাররা ব্যাপারীর মাল বিক্রি করেন কমিশনের ভিত্তিতে। প্রতিদিন বাজার যেভাবে ওঠানামা করে, সেভাবেই তাদের বিক্রি করতে হয়। অনেক সময় ব্যাপারীরা লোকসানেও পণ্য বিক্রি করেন বলে তাঁর দাবি। তিনি বলেন, সবজির প্রতি কেজিতে সব মিলিয়ে কেনা দামের চেয়ে ১০ টাকা বেশি বিক্রি করলেই তাঁদের লাভ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে রাখে অনেক বেশি।

কারওয়ান বাজারের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা বিভিন্ন পণ্যে বিভিন্ন হারে কমিশন রাখেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলেন, শিমের কেজিতে এক টাকা, সব ধরনের কপিতে ৩ থেকে ৪ শতাংশ।

তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করেন—এটা স্বীকার করছেন তাঁরা। তার পেছনে অনেক যুক্তিও দাঁড় করান। মানিকনগর বাজারে সবজি বিক্রেতা আনোয়ারও দেখালেন নানা ধরনের খরচের হিসাব। তাঁর খরচের ফর্দে রয়েছে পচে যাওয়া মালের দাম সমন্বয়ও। তিনি বলেন, কেউ ১০ কেজি মুলা আনলে সে ১০ কেজি বিক্রি করতে পারে না। কারণ ক্রেতা কিনেন বেছে বেছে। ফলে কিছু নষ্ট মাল ফেলে দিতে হয়, কিছু আনার পর পচে যায়, আর কিছু বাসি হয়, সেগুলো কম দামে বিক্রি করতে হয়। এসব খুরচ সমন্বয় করতে হয়। এ ছাড়া মাল কিনে বাজারের যে জায়গায় রাখি সেখানকার ভাড়া, মিনতি বা লেবার খরচ, বাজারে আনতে ভ্যানভাড়া এবং শেষে দোকানভাড়া—এই চার ধরনের খরচও পণ্যের সঙ্গে যোগ করতে হয়। আনোয়ার বলছেন, ‘পাইকাররা বিক্রি করেন মণ দরে, আমাদের করতে হয় ১০-২০ কেজি। ফলে আমাদের মুনাফাটাও কিছুটা বেশি ধরতে হয়।’

বগুড়ার ট্রাকচালক এমরান হোসেন। তিনি নিয়মিত বগুড়া থেকে ঢাকায় সবজি নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, চাঁদা তো সব জায়গাতেই দিতে হয়। আগে প্রকাশ্যে দিতে হতো, এখন গোপনে দিতে হয়। যেখান থেকে ভাড়া করা হয় সেখানেও টাকা রাখা হয়। আর প্রতিটি পৌরসভায় চাঁদা দিতে হয়। দু-এক জায়গায় পরিবহন মালিক সমিতিও চাঁদা নিচ্ছে। পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে তো দেশের কোথাও যাওয়া যায় না।

যশোরের ট্রাকচালক রবিউল বলেন, ‘যশোরের বারীনগর বাজার থেকে ঢাকায় আসতে বেশ কয়েক জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। ফেরিঘাটেও দ্বিগুণ টাকা দিতে হয়। পৌরসভা ও সংগঠনের নেতাদেরও তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে নানা অজুহাতে ট্রাক আটকায়, হয়রানি করেন। পণ্য পচনশীল হওয়ায় ঝামেলা এড়াতে আগে থেকেই টাকার ব্যবস্থা করে রাখে সবাই।’

বাংলাদেশ কার্ভাড ভ্যান ট্রাক পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মকবুল আহমেদ বলেন, ‘পৌরসভার টোল আদায়ের নামে ট্রাকচালকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। পৌরসভা থেকে কোনো ধরনের মালামাল ওঠানো বা নামানো না হলেও তাদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। যশোর থেকে যদি মালামাল নিয়ে ঢাকা আসে, তাহলে কতগুলো পৌরসভা আছে। সব পৌরসভাকে যদি চাঁদা দিতে হয় তাহলে খরচটা কেমন?’ তিনি বলছেন, এ ছাড়া বেশ কয়েক জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে ট্রাক আটকে হয়রানি করে। তাই বাধ্য হয়েই তাদের দিতে হয়।

মকবুল বলছেন, ‘আমি মনে করি, রাস্তায় সব ধরনের চাঁদা বন্ধ হলে ভোক্তা পর্যায়ে দাম অনেক কমে যাবে।’

আপনার মন্তব্য লিখুন